Type Here to Get Search Results !

জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধির কারণ ও প্রতিকার

বাঙ্গালির সিন্ডিকেটের সুলুক সন্ধান। 

আহলান এগ্রোতে আমরা গরুকে ঘাস কিনে খাওয়াই। রতন ভাই আমাদের ঘাস দিয়ে যায় নিয়মিত। প্রতি কেজি ৭ টাকা দরে আমরা কিনে নেই তার কাছ থেকে। ৭ টাকা শুনে আপনার মতো আমরাও আঁতকে উঠেছিলাম, এতো দামে ঘাস কিনে গরুকে খাওয়াবো। রতন ভাইয়ের কাছ থেকে ঘাস কেনার পাশাপাশি মানিকগঞ্জে চললো তাই আমার ঘাসের দাম নিয়ে যাচাই বাছাই। প্রথমে ভাবলাম জমি লিজ নিয়ে নিজেই আবাদ করবো, কিন্তু ওটাতে ভেজাল অনেক, পরে ভাবলাম রতন ভাইয়ের মতো আমরাও পুরো জমির ঘাস কিনে, নিজেরা কেটে, পিকআপে করে ঢাকায় নিয়ে আসবো। ভার্সিটির বড়ভাই আরিফ ভাইকে নিয়ে মানিকগঞ্জ চষে বেড়ালাম, জমিওয়ালাদের সাথে কথা বললাম, পিকওয়ালার রেট নিলাম, লেবার খরচ জানলাম। দুজনে মিলে ঘাটাঘাটি করে, সব হিসেব নিকেশ করে দেখি ঘাসের দাম পড়ে ৯-১০ টাকা। আবার ব্যাক টু দ্যা পেভিলিয়ন, রতন ভাইয়ের ঘাস নিয়ে খুশী মনে গরুকে খাওয়াচ্ছি।

এখন কথা হলো, রতন ভাই ৭ টাকায় দিতে পারলে আমাদের কস্টিং এতো বেশি পড়ে যাচ্ছে কেনো। উত্তর হলো, রতন ভাই নিজে ঘাস কাটে, সাথে লেবার নিয়ে নেয়, নিজের পিক আপ, সে নিজে গাড়ি চালায়, নিজে মাথায় করে গাড়ি থেকে ঘাস নামিয়ে স্কেলে ওজন করে একদম আমার গরুর শেডে পৌছে দেয়। এই প্রতিটা স্টেপে আমাকে আর আরিফ ভাইকে বাইরের লোক হায়ার করে, ভাড়া করা পিক আপ ভ্যান দিয়ে করতে হতো। এর বাইরে দীর্ঘদিন ব্যবসার কারণে রতন ভাই ঢাকার অনেক বড় বড় খামারে ঘাস দেয়, সে ইকোনমিস অফ স্কেলটা পেয়েছে। বেশি ভল্যুম হবার কারণে এই দামে দিতে পারে, আমরা পারছি না।

ইন্টারনেট ও ফোনের কারণে আমাদের কাছে এখন অনেক ডেটা এভেইলেবল। কিন্তু ডেটাকে প্রসেস করে ইনফরমেশনে রুপান্তর করার সক্ষমতা অধিকাংশ লোকের নেই। টিভি চ্যানেলের রিপোর্ট, মোবাইল ফোন বা ইউট্যুব ভিডিওর কারনে আমাদের কাছে ডেটা আছে যে, পটুয়াখালীর গলাচিপায় ৪০-৫০ টাকা পিস দরে কৃষক তরমুজ বিক্রি করে, কিন্তু সেটা কেনো ঢাকায় ১৫০-২০০ টাকা সেটার ইনফরমেশন আমাদের কাছে নেই বা থাকলেও আমরা সেটা তুলে ধরতে চাই না। 

আগে বলেছিলাম, মিনা, আগোরা সহ অনেকেই কৃষক-কনস্যুমার মডেলে কাজ করার চেষ্টা করেছিলো। এমনকি সরকারও চেষ্টা করেছিলো, মানিক মিয়াতে কি কৃষক বাজার না কি জানি, মতিঝিলে কৃষি ভবনের নীচে দেখতাম, বড় বড় কাভার্ড ভ্যানে
মাছ বিক্রি করতো। এ মডেলটা মিজারেবলি ফেইল করেছে, ফেইল করতে বাধ্য। আপনারা কথায় কথায় যাদের সিন্ডিকেট নামে অবহিত করেন, তারা হলো এই বাজার অর্থনীতির এক একজন কন্ট্রিবিউটর। সবার কন্ট্রিবিউশনের মাধ্যমেই একটা পণ্য গ্রাম থেকে শহরে আপনার বাসার নীচে পর্যন্ত পৌছাচ্ছে। হাজার বছরের ট্রায়াল এ্যান্ড এররের মধ্য দিয়েই এই বাজার ব্যবস্থাপনা গড়ে উঠেছে। এখন আপনি যখন এই এতোগুলো হাতকে বাইপাস করে সরাসরি কৃষক থেকে কনস্যুমারের কাছে পন্য পৌছাতে যাবেন, রতন ভাইদের কস্টিং এর কাছে পারবেন না। রতন ভাইরা দীর্ঘদিন ব্যবসা করে করে, বিভিন্ন পয়েন্টে খরচ কমিয়ে কমিয়ে আপনাকে সর্ব্বোচ্চ কম দামে পন্য দিচ্ছে। এমনকি মাঝে মাঝে রতন ভাইরা লস করেও আমাদেরকে প্রোডাক্ট দেয়।

আজকের পোস্টে আমরা দেখবো কেনো গ্রামের ৪০-৫০ টাকার তরমুজ ঢাকায় ১৫০-২০০ টাকা পড়ছে এবং কেনই বা কৃষক- কনস্যুমার মডেল কাজ করছে না, প্রধান সমস্যাগুলো কোথায়? চলুন শুরু করা যাক। 

১। প্রোডাক্ট কেনা: 

গ্রামের কৃষক হলো লজ্জাশীলা নারীর মতো। বুক ফাটে তো মুখ ফুটে না। আপনি যে দাম বলছেন সে হয়তো সে দামেই আপনাকে পণ্যটা দিতে রাজি, কিন্ত সরাসরি কিছু বলবে না। তার কাছে বিভিন্ন নাটক সিনেমা করে, অনুরোধ বিনোরধ করে, মুখ খারাপ করে, গায়ে হাত বুলিয়ে, অনেকটা জোর জবরদস্তি করে পণ্যটা কিনতে হবে, যেটা আমার আপনার মতো শহুরে শিক্ষিত লোকের জন্য শুধু কষ্টসাধ্যই নয়, অনেকক্ষেত্রে অসম্ভব। তাদের কাছ থেকে গ্রামের ওই পারচেজ এজেন্ট আপনারা যাদের দালাল বলেন, সে-ই ভালো কিনতে পারে। আমি গ্রাম থেকে গরু কিনতে যেয়ে এই বাস্তবতা ফেইস করেছি। একথা গরুর ক্ষে্ত্রে যেমন সত্য তেমনি অন্যান্য পণ্যের ক্ষেত্রেও সত্য।

২) প্রোডাক্ট সর্টিং: 

বাজার থেকে তরমুজ কিনলে আমি সাধারণত কেটে দেখে নিতে আগ্রহ বোধ করিনা। প্রথম কারণ হলো, এখন তরমুজ এ এমন সব কেমিকেল ও হরমোন দেয়া হয়, পুরুষ্ঠ প্রায় সব তরমুজই লাল হয়। আর দ্বিতীয় বা আসল কারণ হলো, একটা জমিতে বড় তরমুজ হয়, ছোট তরমুজ হয়, সব তরমুজের সাইজ এক হয় না। কিছু তরমুজ লাল হবে, কিছু হবে সাদা। আম নেয়ার সময় সবাই বেছে বেছে বড়, সুন্দর, নিখুঁত আম নেই। কিন্তু একটা গাছে তো বড়, ছোট, সুন্দর, অসুন্দর, নিখুঁত, দোষযুক্ত- সব ধরনের আমই হয়। সবাই ভালো আম, বড় আম নিলে ছোট আমগুলো নিবে কে। ব্যবসায়ী বলে আমার মধ্যে এমপ্যাথি কাজ করে, সব ধরনের আমই নেয়ার চেষ্টা করি। 

এখন প্রশ্ন আসতে পারে, একটা গাছে তো সব ধরণের আমই হয়, তরমুজ তো একটা জমিতে বিভিন্ন সাইজের হয়, তাহলে ঢাকার দোকানগুলোতে এরকম বাছাই করা সব বড় বড় তরমুজগুলো, আমগুলো কোথা থেকে আসে। এই বাছাইটা করে কে। আপনারা যাকে কথায় কথায় সিন্ডিকেট সিন্ডিকেট বলে গালাগালি করেন, এই কাজটা করে এই সিন্ডিকেটওয়ালারা, আপনাদের মধ্যস্বত্বভোগীরা। 

গ্রামের বা শহরের আড়তদারেরা কৃষকের পুরো জমির তরমুজ কিনে নেয়। কৃষক কখনো বেছে বেছে তার বড় বড় তরমুজ বিক্রি করবে না, সে পুরো জমি ধরে বিক্রি করবে। সে ৪০-৫০ টাকা এভারেজ রেট ধরে ছোট, বড় সব তরমুজ আড়তদার বা গ্রামের পারচেজ এজেন্টের কাছে বেচে দেয়। এরকম অনেক কৃষকের ক্ষেতের সব তরমুজ আড়তে আসে। আড়তওয়ালা বসে বসে আপনাদের জন্য তরমুজের ক্যাটাগরি করে, বড় তরমুজ, মাঝারি তরমুজ, ছোট তরমুজ। বড় তরমুজগুলো একটু ভালো দামে বিক্রি করা হয়, মাঝারিগুলো মাঝারি দামে এবং আপনারা যেগুলো নেন না, ছোট, নষ্ট, দাগওয়ালা, ভেতরে সাদা, এগুলোর স্থান হয় ভ্যানে বা কমদামী স্থানে, কম দামে সেগুলো বিক্রি হয়। এগুলো দেখা যায়, আড়তওয়ালা কেনা দামের চেয়েও কম দামে বিক্রি করে। এবং এই কারণে ভ্যানের ফল বা সবজির দাম বাজারের স্থায়ী দোকানের চেয়ে কম হয়। আপনারা যে অভিযোগ করেন না, অনলাইনে আমের দাম বেশী, ভ্যানের দামের সাথে তুলনা করেন, মূল পার্থক্যটা হয় এই জায়গায়। অনলাইনওয়ালারা আপনাকে প্রিমিয়াম গ্রেডের আম দেয়, কেজিতে ৩-৪ টা, নাহলে তো আপনি আবার ছবি তুলে ব্যাড রিভিউ দিবেন। আর ভ্যানওয়ালারা দিবে বাছাই করার পর সবচেয়ে লো গ্রেডের মালটা। 

পোস্টের শুরুর দিকে বলেছিলাম, অধিকাংশ মানুষের কাছে ডেটা আছে কিন্তু সেটাকে ইনফরমেশনে রুপান্তর করার ক্যাপাসিটি নেই। টিভির সাংঘাতিকরা বা ইউট্যুবের ছোকরারা আপনাকে বলবে গলাচিপায় ৪০ টাকা দরে তরমুজ বিক্রি হচ্ছে, শহরে কেনো তা ৩০০-৪০০ টাকায়। প্রোডাক্ট সর্টিং হচ্ছে এটার উত্তর। ৩০০-৪০০ টাকায় তো সবচেয়ে প্রিমিয়াম গ্রেডের, সবচেয়ে বড় তরমুজটা বিক্রি হচ্ছে, বাকি তরমুজগুলো কোথায় যাচ্ছে। ওগুলো সর্টিং হয়ে ভ্যানে যায়, সেখানে অনেক সময় ৪০-৫০ টাকায়ও তরমুজ পাওয়া যায়। একজন আড়তদার তার কেনা সবগুলো মাল একসাথে করে প্রিমিয়ামগুলো থেকে লাভ করে, মাঝারিগুলো থেকে সমান সমান বা কম লাভ করে এবং ছোটগুলো থেকে অধিকাংশ সময় লস করে ছেড়ে দেয়। তাই অনলাইনওয়ালা বা আড়তদার বা আপনাদের ভাষার সিন্ডিকেটওয়ালাদের গালাগালি করার সময় একটু ইনসাফ করে গালাগালি করবেন। 

এখন আসেন আমাদের লেখার মূল পয়েন্টে, কৃষক-কনস্যুমার মডেল কেনো সাসটেইনেবল না। মিনা, আগোরা বা সরকারের মতো জায়ান্টরা বা আমাদের তরুণ ব্লাডরা কেনো এই মডেলে ফেইল করছে। এই মডেল নিয়ে যারা কাজ করছে তাদের কাস্টমার একটু এলিট গোষ্ঠী, তারা ওই প্রিমিয়াম গ্রেডের মালটা নিয়ে অভ্যস্ত। কিন্তু কৃষকের থেকে মাল কিনলে তো পুরো ক্ষেত কিনতে হবে, ছোট, বড়, মাঝারি। আপনি এগুলো গ্রামের কৃষকের থেকে ৫০ টাকায় কিনে যখন শহরে কম লাভ করে ১০০ টাকায় বিক্রি করতে যাবেন, তখন সবাই বেছে বেছে বড়গুলো নিয়ে যাবে, দিনশেষে আপনাকে ছোট আর মাঝারিগুলো নিয়ে বসে মাথা চাপড়াতে হবে। কেনা দামও পাবেন না। পুরো চালান মিলে আপনাকে লস গুনতে হবে। কারণ একটা ক্ষেতে বা আমগাছে আমার ধারণামতে ৩০-৪০ শতাংশের বেশি প্রিমিয়াম গ্রেডের প্রোডাক্ট হয় না। আপনাকে চালান তুলতে হলে বা লাভ করতে হলে প্রিমিয়াম গুলো প্রিমিয়াম দামেই বেচতে হবে, মাঝারিগুলো একটু কম লাভ করে এবং ছোটগুলো লসে ছেড়ে দিতে হবে। নাহলে আকাশভরা তারা গোনা অনিবার্য। আড়তগুলোর এই পুরো ইকোসিস্টেমটা আছে, কিন্তু মিনার, আগোরার, সরকারের বা আমাদের তরুণ উদ্যোক্তাদের এই ইকোসিস্টেম নেই। তাই এই মডেল কাজ করে না। 

এ প্রসঙ্গে বলে রাখি, আমরা আহলান এগ্রোতে গরুর মাংসের ক্ষেত্রে এরকম ক্যাটাগরি করে মাংস সেল করি। মাংসের ক্ষেত্রে সবাই শিনা, সামনের রান আর কুরুলির মাংস চায়। এগুলো প্রিমিয়াম গ্রেডের জিনিস, হাড়, চর্বি কম, খেতে স্বাদ বেশি। এই পার্টসগুলো মিলিয়ে একটা গরুর ২৫-৩০% হয়, বাকিগুলো নিয়ে আমাদের বিপদে পড়তে হয়। তাই প্রিমিয়াম জিনিস আমরা প্রিমিয়াম দামে বেচি, বাকিগুলো একটু কম দামে। দুই গ্রুপের প্রতিই এহসান করা হয়, আমাদেরও পুরো গরুর মাংস বিক্রি করতে বেগ পেতে হয় না।

৩। প্রোডাক্ট ডাইভার্সিটি: 

প্রোডাক্ট ডাইভার্সিটি হলো কৃষক-কনস্যুমার মডেলের সবচেয়ে বড় বাধা। ঢাকায় একটা সবজির দোকান দিতে হলে ন্যুনতম ১৫-২০ পদের আইটেম লাগবে। এখন আলু ভালো হয় নীলফামারীতে, রসুন ভালো হয় পঞ্চগড়ে, মরিচ ভালো হয় বগুড়ায়, পেয়াজ ভালো হয় 
শরীয়তপুরে, হলুদ ভালো হয় পাহাড়ে। সরাসরি কৃষকের থেকে পণ্য নিয়ে ঢাকার একটা দোকান সাজাতে আপনাকে ছুটে বেড়াতে হবে দেশের আনাচে কানাচে। কারওয়ান বাজার ওভার দ্যা পিরিয়ড এই ইকোসিস্টেমটা ডেভেলপ করে ফেলেছে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে যে এলাকায় যে পণ্যটা ভালো হয়, কম দামে পাওয়া যায়, সেখান থেকে সে পণ্যটা চলে আসে। 

আবার একই পণ্য একেক এলাকায় একেক সময় পাওয়া যায়। যেমন দুদিন আগে তথ্য পেলাম, দক্ষিণবঙ্গে নাকি সজনে খাওয়া প্রায় শেষের দিকে। অথচ ঢাকাতে সজনে এখনো সুতা সাইজের। উত্তরবঙ্গের দিকে সজনে নামতে আরও দেরী। অন্যান্য ফসলের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। রাজশাহী, চাপাইয়ের আম নামতে নামতে ততোদিনে সাতক্ষিরার আম খাওয়া সাড়া। সো, দেখা যাচ্ছে, আপনি যদি শুধু একটা প্রোডাক্ট নিয়েও কাজ করেন, পুরো সিজন জুড়ে ব্যবসা করতে চাইলে আপনাকে দেশের বিভিন্ন এলাকায় ওই প্রোডাক্টের লাইফ সাইকেল নিয়ে ধারণা থাকতে হবে এবং সেভাবে দেশব্যাপি নেটওয়ার্ক বিল্ডআপ করতে হবে। পারবেন এরকম ১৫-২০ পদের আইটেমের সাপ্লাই চেইন রেডি করতে। 

৪। ট্রান্সপোর্টেশন:

রতন ভাইয়ের কথা বলেছিলাম না, রতন ভাইয়ের নিজের পিক আপ ভ্যান রয়েছে যেটাতে করে সে নিজে ঘাস কেটে, নিজে পিক আপ চালিয়ে, ঘাস মাথায় নিয়ে আমাদের ঘরে ঘাস পৌছায় দেয়। এক, ট্রান্সপোর্টেশনের এই জায়গাটাতেই তো আমরা ধরা। আমরা হিসেব করে দেখেছি আমাদের ট্রান্সপোর্টেশন খরচ অনেক বেশি পড়ে যাচ্ছে রতন ভাইয়ের তুলনায়। সবজি বা ফলের ক্ষেত্রেও লোকাল এজেন্টরা এরকম কস্ট ইফেক্টিভ মেথডে সবজি ট্রান্সপোর্ট করে থাকে। নীলফামারীতে দেখেছি, ওদের হাইওয়ে বাসের সাথে কন্ট্রাক্ট করা থাকে, বাসের ছাদে অথবা লকারে করে 
সবজি নিয়ে আসে খুবই অল্প খরচে। এমনও দেখেছি এলাকার ব্যাপারিরা ছাগলও বাসের লকারে করে ঢাকায় পাঠিয়ে দেয়। গ্রামের এজেন্টদের সাথে বাসওয়ালাদের এমন সম্পর্ক হয়ে গিয়েছে গ্রাম থেকে সবজি কালেক্ট করে তাদের আর এখন বাজারেও নিয়ে আসতে হয় না বাসে তুলে দেয়ার জন্য। গ্রামের রাস্তার ধারে তারা সবজি রেখে দেয়, বাসওয়ালারা ওই পথে যাবার সময় সবজিগুলো তুলে নেয়। জমি- বাজার, ইন্টারনাল যে ট্রান্সপোর্ট খরচ, এইটাও তাদের সেইভ হয়। আমি আপনি শহুরে বাবু ট্রাক ভাড়া নিয়ে নাহলে পিক আপে করে সবজি ঢাকায় নিয়ে আসবো। আমাদের ট্রান্সপোর্টেশন খরচ কোথায় গিয়ে ঠেকবে। আপনি যদি বাসেও সবজি আনেন গ্রামের এজেন্টের প্রাইসে আপনি কখনই বাসে আনতে পারবেন না, কারণ আপনার লেনদেন একদিনের, ওদের সারাবছরের।

৫) ইকোসিস্টেম: 

গ্রাম থেকে সবজি এসে ঢাকার যে আড়তগুলোতে আনলোড হয়, বছরের পর বছর ধরে সেখানে একটা চমৎকার ইকোসিস্টেম তৈরি হয়েছে। এখানে লেবার পাওয়া যায়, ভ্যান পাওয়া যায়, পিক আপ পাওয়া যায় এবং মোস্ট ইম্পোর্টেন্টলি সবজিটা খুব দ্রুত সেল হতে হবে, সেজন্য প্রচুর কাস্টমার দরকার, যেটা এই আড়তগুলোতে রয়েছে। বছরের পর বছর ধরে এই কাজ করার কারণে এখানকার লেবার বা অন্যান্য সেক্টরের লোকজন সংশ্লিষ্ট কাজটাতে খুবই দক্ষ এবং খুবই অল্প খরচে তার কাছ থেকে সেবা পাওয়া যায়। 

যারা ট্রেডিশনাল এই সাপ্লাই চেইনকে বাই পাস করে নিজেরা সবজি নিয়ে আসে তাদের এই ইকোসিস্টেমটা থাকে না। তাদেরকে অনেক বেশি খরচ করে অদক্ষ জনবল দিয়ে ধাক্কায় ধুক্কায় কাজ চালায় নিতে হয়। ফলে তারা কস্টিংএ ট্রেডিশনাল চ্যানেলের সাথে কখনই পেরে ওঠে না, পারবেও না। 

৬) লেফট ওভার:

আহলানের আকিকা সেবার জন্য প্রায় আমাদের খাশী কেনা লাগে। গাবতলিতে আমাদের একজন ভালো ভেন্ডর আছে, তার কাছ থেকে তুলনামূলক কম দামে, হ্যাসেল ফ্রি ভাবে কেনা যায়। তো, সেদিন গিয়েছি ছাগলের হাটে, আমার সামনেই একটা খাশীর মর মর অবস্থা। ব্যাপারি সাথে সাথে সেটা জবাই দিয়ে মাংস কশাইয়ের কাছে দিয়ে দিলো ৮০০ টাকা কেজি দরে। আমি চিন্তা করে দেখলাম, আমাদের এগ্রোতে হলে এই খাশীটা নিয়ে কি বিপদেই না পড়তে হতো। হয় খাশীটা মরে যেতো অথবা নিজেদের খেয়ে ফেলতে হতো, কেনা দামও পেতাম না। অথচ গাবতলির ব্যাপারিরা কি সুন্দর চালান তুলে ফেললো।

লাইভ প্রোডাক্ট বা কাঁচা আইটেম করলে এরকম প্রোডাক্ট ড্যামেজ হওয়ার চান্স থাকে। এটার প্রোপার ইউটিলাইজেশন করতে না পারলে লস টানতে হয় ব্যাপক। আড়তগুলো বা হাটগুলোতে এরকম লেফট ওভার আইটেম কেনাবেচার চমৎকার একটা ইকোসিস্টেম আছে। এধরণের প্রোডাক্ট যারা কিনে তাদের সেখানে আনাগোনা আছে। কিন্তু আপনি যখন দূরে, একা এই কাজ করতে যাবেন, তখন এই লেফট ওভার আইটেমগুলো নিয়ে মাথা চাপড়াতে হবে। 

লেখা শেষ করবো৷ সামারি করছি, আমার আজকের এই লেখাটার মূলত দুটো উদ্দেশ্য:

এক, কথায় কথায় যাদের সিন্ডিকেট বলা হয়, গালাগালি করা হয়, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির খলনায়ক বানানো হয়, বাজার অর্থনীতিতে তাদের অবদান তুলে ধরা। তারা যে আকাশছোঁয়া দাম হাকিয়ে আপনার পকেট কাটছে না, সেটা বোঝানো।

দুই, গ্রামের দশ টাকার ফুলকপি ঢাকায় ষাট টাকা কেনো বলে যারা শেকল ভাঙ্গার গান গেয়ে মাঠে নামতে চান, তাদের দেখানো আপনি এই ট্রেডিশনাল চ্যানেল বাইপাস করে একা নিজে কিছু করতে গেলে এই ফুলকপির দাম দুইশ টাকা পড়বে। 

আমাদের এই সবজি মার্কেট, মাছ, মাংস, ডিম, দুধ, চাল, ডালের মার্কেট মারাত্মক প্রাইস সেনসিটিভ। এখানে এক দুইজনের পক্ষে মার্কেট ডিক্টেট করা, গলাকাটা দাম রাখা কখনই সম্ভব নয়। সাপ্লাই চেইনের ৭-৮ টা হাতকে প্রোপার প্রফিট দিয়ে গ্রাম থেকে কেনা পন্যটি ঢাকায় যে দামে বিক্রি হয়, সেটা খুবই জাস্টিফাইড, ক্ষেত্রবিশেষে আন্ডারপেইড। যে পরিমাণ, কষ্ট, ত্যাগ স্বীকার করে এই লোকগুলো এই পণ্যগুলো ঢাকায় বা অন্যান্য শহরে নিয়ে আসে তাদের পরিশ্রমের সঠিক মজুরি আমরা অধিকাংশ সময় দিতে পারি না। সারারাত না ঘুমিয়ে, গতর খেটে, অমানুষিক পরিশ্রম করে এই লোকগুলো একদম আমাদের বাসার নীচে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যগুলো পৌঁছে দিচ্ছে, অথচ দিনশেষে তাদেরকেই গালাগালি করতে আমরা বিন্দুমাত্র ছাড় দেই না। এই লোকগুলো আহামরি লাভ করে ঢাকায় বিল্ডিং বানিয়ে ফেলছে তা কিন্তু নয়, বানিয়ে ফেললেও দোষের কিছু নয়, তাদের পরিশ্রমের বিপরীতে তারা এটা ডিসার্ভ করে। 

বিক্রেতা যদি ক্রেতার জুতো পায়ে না দেই বা ক্রেতা যদি বিক্রেতার জুতো পায়ে না দেয়, একজন আরেকজনের দু:খ কষ্ট, ব্যাথা, বেদনা, হাসি আনন্দের জায়গাগুলো না বুঝে তাহলে আমরা কখনই একটা ভালো বাজার ব্যবস্থাপনা পাবো না। একে অপরকে গালাগালি করতে করতেই আমাদের দিন চলে যাবে।
সূত্র: Sagorhasnat vai

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

Search This Blog