এই দেশে প্রাথমিকের শিক্ষকদের রাষ্ট্রের তৃতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসেবে গণ্য করা হয়। বাংলাদেশে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকরা ১৩তম গ্রেডে বেতনভাতা পান। এই গ্রেড স্কেলে মুলবেতন হলো ১১,০০০।
আর ভারতের কলকাতায় ভারতীয় রুপিতে ৩৮ হাজার টাকা। অথচ সেখানে বাসা ভাড়া থেকে শুরু করে দ্রব্যমূল্য বাংলাদেশ থেকে কম। বাংলাদেশের অনেক বেসরকারি কলেজ ও স্কুলে শিক্ষকদের বেতন এমন পর্যায়ে, যা জীবনের মৌলিক চাহিদা মেটাতেই অপ্রতুল। এর ফলে প্রতিভাবান তরুণেরা শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে নিতে নিরুৎসাহিত হচ্ছেন।
একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক হয়তো কিছুটা মর্যাদা পান, কিন্তু প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক, যিনি শিশুর চিন্তার ভিত্তি গড়ে দেন, তাকে এখনো প্রান্তিক ভূমিকায় ঠেলে রাখা হয়।
অথচ প্রকৃত শিক্ষার বীজ তো রোপিত হয় প্রাথমিক স্তরেই। সেখানেই শেখানো উচিত সমাজে চলতে গেলে নিজেদের দায়িত্বগুলো কী। কোথায় ময়লা ফেলা যাবে আর কোথায় যাবে না, বাসে উঠলে কাকে দেখলে নিজের সিটটা ছেড়ে দিতে হয়, রাস্তাঘাট কীভাবে পার হতে হয়, প্রাণীদের প্রতি কেমন আচরণ হওয়া উচিত—এইসব শিক্ষা সেই শিশু অবস্থাতেই শিখিয়ে একদম হৃদয়ে গেঁথে দিতে হয়। উন্নত বিশ্ব যেমন জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, ইউরোপে ঠিক এটাই করে।
গ্রামীণ ও শহুরে স্কুলের মধ্যে প্রযুক্তি ব্যবহারের যে দূরত্ব, তা কেবল শিক্ষার্থীদের নয়, শিক্ষকদের মধ্যেও বৈষম্য তৈরি করছে। তাই শিক্ষক দিবসের প্রতিশ্রুতি হতে পারে—প্রত্যেক শিক্ষক যেন ডিজিটাল যুগে দক্ষ ও আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠতে পারেন, তার জন্য প্রয়োজন সুনির্দিষ্ট নীতিগত সহায়তা ও প্রশিক্ষণ কর্মসূচি।
শিক্ষককে সম্মান দেওয়া মানে কেবল আবেগ নয়, এটি এক জাতীয় দায়িত্ব। আমাদের বুঝতে হবে যে একজন সৎ শিক্ষক একটি জাতিকে গঠন করতে পারে। কিন্তু সেই শিক্ষককে যদি আমরা অনিরাপত্তা, বঞ্চনা ও প্রশাসনিক জটিলতায় আটকে রাখি, তবে আমরা তাকে অজ্ঞানতাবশত নানা অসৎ বা অনৈতিক পথে ধাবিত হতে উৎসাহিত করছি যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মানসম্মত শিক্ষা প্রদানকে ব্যাহত করছি।
খুবই সামান্য বেতনের কারণে নিতান্ত বাধ্য হয়ে শিক্ষকরা পার্টটাইম, প্রাইভেট এবং কোচিং-এ পড়ায়। সেটা করতে গিয়ে কেউ হয়তো বেশি করে ফেলে। কারণ একবার শুরু করে ফেললে এর গহ্বর থেকে বের হওয়া কঠিন। তাই রাষ্ট্রের উচিত শুরু থেকেই এমন বেতন ব্যবস্থা করা যাতে শিক্ষকরা আত্মসম্মান নিয়ে সমাজে মাথা উঁচু করে চলতে পারে। সেই সম্মান এবং সম্মানী নিশ্চিত হলেই আজকের এই পরিস্থিতি দেখতে হতো না।
আমার নিজের শিক্ষকতার বয়স তিন যুগের বেশি ছাড়িয়েছে। এই দীর্ঘ সময় শিক্ষকতা পেশাতে থেকে বুঝতে পারছি দিন যত যাচ্ছে বাংলাদেশের শিক্ষকদের মান নিচে নামছে। এর কারণ শিক্ষকদের প্রতি রাষ্ট্রের চরম অবহেলা। আমাদের রাজনীতিবিদরা চায় না শিক্ষকরা মেরুদণ্ড নিয়ে চলুক।
সংগৃহীত